জীবনানন্দ দাশ

ভিখিরী

একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো–
তবে আমি হেঁটে চ’লে যাবো মানে মানে।
–ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত।
আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনেযেতে চেয়েছিলো তাঁত;
তবুও তা নুলো শাঁখারীর হাতে হয়েছে করাত।
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো
তাহলে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা।
বলে সে বাড়ায়ে দিলো গ্যাসলাইটে মুখ।
ভিড়ের ভিতরে তবু — হ্যারিসন রোডে —আরো গভীর অসুখ,
এক পৃথিবীর ভুল; ভিখিরীর ভুলে : এক পৃথিবীর ভুলচুক।

মিতাভাষণ

তোমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন।
মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে
ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো
আমাদের নিয়ে যায় ডেকে
শান্তির সঙ্ঘের দিকে — ধর্মে — নির্বাণে,
তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।
অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষয়ে অন্ধকারে,
দেখেছি মণিকা-আলো হাতে নিয়ে তুমি
সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু
দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়তর বেলাভূমি:
যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে
তার স্নিগ্ধ মানতীসৌরভে।
মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;
বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা;
ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প-স্বপ্নের
উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা।
তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল,সূর্য মানে আলো;
এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।


মনোকণিকা

ও. কে.


একটি বিপ্লবী তার সোনা রুপো ভালোবেসেছিলো;
একটি বণিক আত্মহত্যা করেছিলো পরবর্তী জীবনের লোভে;
একটি প্রেমিক তার মহিলাকে ভালোবেসেছিলো;
তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিলো দশজন মূর্থের বিক্ষোভে।


বুকের উপরে হাত রেখে দিয়ে তা’রা
নিজেদের কাজ ক’রে গিয়েছিলো সব।


অবশেষে তা’রা আজ মাটির ভিতরে
অপরের নিয়মে নীরব।


মাটির আহ্নিক গতি সে-নিয়ম নয়;
সূর্য তার স্বাভাবিক চোখে
সে-নিয়ম নয়— কেউ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়;
সব দিক ও. কে.।


সাবলীল


আকাশে সূৰ্যের আলো থাকুক না— তবু—
দণ্ডাজ্ঞার ছায়া আছে চিরদিন মাথার উপরে।
আমরা দণ্ডিত হ’য়ে জীবনের শোভা দেখে যাই।
মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে।


মাঝে-মাঝে পুরুষাৰ্থ উত্তেজিত হ’লে—
(এ রকম উত্তেজিত হয়;)
উপস্থাপয়িতার মতন
অামাদের চায়ের সময়


এসে প’ড়ে আমাদের স্থির হ’তে বলে।
সকলেই স্নিগ্ধ হ’য়ে আত্মকর্মক্ষম;
এক পৃথিবীর দ্বেষ হিংসা কেটে ফেলে
চেয়ে দ্যাখে স্তূপাকারে কেটেছে রেশম।


এক পৃথিবীর মতো বর্ণময় রেশমের স্তূপ কেটে ফেলে
পুনরায় চেয়ে দ্যাখে এসে গেছে অপরাহ্ণকাল:
প্রতিটি রেশম থেকে সীতা তার অগ্নিপরীক্ষায়—
অথবা খ্রীষ্টের রক্ত করবী ফুলের মতো লাল।


মানুষ সর্বদা যদি


মানুষ সর্বদা যদি নরকের পথ বেছে নিতো—
(স্বর্গে পৌঁছুবার লোভ সিদ্ধার্থও গিয়েছিলো ভুলে),
অথবা বিষম মদ স্বতই গেলাসে ঢেলে নিতো,
পরচুলা এঁটে নিতো স্বাভাবিক চুলে,
সর্বদা এ-সব কাজ ক’রে যেত যদি
যেমন সে প্রায়শই করে,
পরচুলা তবে কার সন্দেহের বস্তু হ’তো, আহা,
অথবা মুখোশ খুলে খুশি হ’তো কে নিজের মুখের রগড়ে।


চার্বাক প্রভৃতি—


‘কেউ দূরে নেপথ্যের থেকে, মনে হয়,
মানুষের বৈশিষ্ট্যের উত্থান-পতন
একটি পাখির জন্ম— কীচকের জন্মমৃত্যু সব
বিচারসাপেক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।


‘তবু এই অনুভূতি আমাদের মর্ত্য জীবনের
কিংবা মরণের কোনো মূলসূত্র নয়।
তবুও শৃঙ্খলা ভালোবাসি ব’লে হেঁয়ালি ঘনালে
মৃত্তিকার অন্ধ সত্যে অবিশ্বাস হয়।’


ব’লে গেল বায়ুলোকে নাগার্জুন, কৌটিল্য, কপিল,
চার্বাক প্রভৃতি নিরীশ্বর;
অথবা তা এডিথ, মলিনা নাম্নী অগণন নার্সের ভাষা—
অবিরাম যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বায়ুর ভিতর।


সমুদ্রতীরে


পৃথিবীতে তামাশার সুর ক্রমে পরিচ্ছন্ন হ’য়ে
জন্ম নেবে একদিন। আমোদ গভীর হ’লে সব
বিভিন্ন মানুষ মিলে মিশে গিয়ে যে-কোনো আকাশে
মনে হবে পরস্পরের প্রিয়প্রতিষ্ঠ মানব।


এই সব বোধ হয় আজ এই ভোরের অালোর পথে এসে
জুহুর সমুদ্রপারে, অগণন ঘোড়া ও ঘেসেড়াদের ভিড়ে।
এদের স্বজন, বোন, বাপ-মা ও ভাই, ট্যাঁক, ধর্ম মরেছে;
তবুও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে।


   (মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ)

নির্জন সাক্ষর

তুমি তা জানো না কিছু—না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে’—
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার এ জীবনের ধার
ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই;
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে;
আমি ঝ’রে যাবো–তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে,
—আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।


রয়েছি সবুজ মাঠে—ঘাসে—
আকাশ ছডায়ে অাছে নীল হ’য়ে আকাশে-আকাশে;
জীবনের রং তবু ফলানো কি হয়
এই সব ছুঁয়ে ছেনে’;—সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা—আকাশেও নাই তার স্থল,
চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল;
রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে
তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে


নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।


একবার কথা ক’য়ে দেশ আর দিকের দেবতা
বোবা হয়ে পড়ে থাকে—ভুলে যায় কথা;
যে-আগুন উঠেছিলো তাদের চোখের তলে জ্ব'লে
নিভে যায়—ডুবে যায়—তারা যায় স্খ’লে।
নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে—চ’লে আসে নতুন সময়—
পুরানো সে-নক্ষত্রের দিন শেষ হয়
নতুনেরা আসিতেছে ব’লে;
আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ’লে
কোনো এক মানুষীর তরে
যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে।
আমি সেই পুরোহিত—সেই পুরোহিত।
যে-নক্ষত্র ম’রে যায়, তাহার বুকের শীত
লাগিতেছে আমার শরীরে—
যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে
তুমি আছো জেগে—
যে-আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে
জেগে আছো;
জানিয়াছো তুমি এক নিশ্চয়তা—হয়েছো নিশ্চয়।
হ’য়ে যায় আকাশের তলে কতো আলো—কতো আগুনের ক্ষয়;
কতোবার বর্তমান হ’য়ে গেছে ব্যথিত অতীত—
তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত
যে-নক্ষত্র ঝ’রে যায় তার।
যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার।
জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে
পারো তুমি;
তোমার আকাশে তুমি উষ্ণ হ’য়ে আছো—তবু—
বাহিরের আকাশের শীতে


নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়,
নক্ষত্রের মতন হৃদয়
পড়িতেছে ঝ’রে—
ক্লান্ত হ’য়ে—শিশিরের মতো শব্দ ক’রে।
জানোনাকো তুমি তার স্বাদ—
তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ,
জীবন অগাধ।


হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার।
তোমার আকাশ—আলো—জীবনের ধার
ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে।
আমি চ’লে যাবো—তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে;
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।

0 comments:

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More
Follow Us on Twitter!Follow Us on Twitter!

 
Design by Free WordPress Themes | Bloggerized by Lasantha - Premium Blogger Themes | Best Hostgator Coupon Code